Friday, August 15, 2014

ইসলামের এক জ্বলন্ত মোজেজা ইমাম বোখারি (রহ.)

ইসলামের ঊষালগ্ন থেকে এমন কিছু সোনার মানুষের আবির্ভাব হয়েছে, যাঁদের প্রভাব এবং বিভায় এ বসুন্ধরা এখনো এত অনিন্দ্যসুন্দর, শান্তি এবং জ্ঞানের প্রতিভু হয়ে যাঁরা এ বিশ্বকে আলোকিত করেছিলেন। পৃথিবীতে বিপ্লব সৃষ্টিকারী
সেসব আলোকিত মানুষের মধ্যে অন্যতম হলেন- আমিরুল মু'মিনীন ফিল হাদিস, ইসলামের এক জ্বলন্ত মোজেজা, ইমাম বোখারি (রহ.)। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বর্তমানে উজবেকিস্তানের অধীনে মুসলিম অধ্যুষিত একটি প্রসিদ্ধ নগরী বোখারায় বিশ্ববরেণ্য হাদিস শাস্ত্রবিদ ইমাম বোখারি (রহ.) ১৯৪ হিজরির ১৩ শাওয়াল মোতাবেক ৮১০ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই জুমার নামাজের পর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম মুহাম্মদ, উপনাম আবু আবদুল্লাহ। উপাধি আমিরুল মু'মিনীন ফিল হাদিস। জন্মস্থান বোখারায়, তাই তাঁকে বোখারি বলা হয়। তাঁর বাবা ইসমাইল, দাদা ইবরাহিম। তাঁর বাবা ছিলেন প্রসিদ্ধ হাদিস বিশারদ। তিনি ছিলেন তৎকালীন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হাম্মাদ (রহ.) ও ইমাম মালেক (রহ.) (৯৩-১৭৯ হি.)-এর অন্যতম শাগরেদ। ইমাম বোখারি (রহ.) শিক্ষা, জ্ঞান ও যোগ্যতা শুধু পিতার দিক থেকেই পাননি, বরং মায়ের দিক থেকেও অর্জন করেছিলেন। ইমাম বোখারি (রহ.)-এর মাও ছিলেন একজন মহীয়সী নারী। তিনি শৈশবেই পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হন। লালিত-পালিত হন তাঁর মমতাময়ী মায়ের কোলে।
শিক্ষাজীবন : ইমাম বোখারির শিক্ষাজীবন শুরু হয় কোরআন তেলাওয়াত দিয়ে। মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি কোরআন মুখস্থ করেন। ১০ বছর বয়স থেকে তিনি হাদিস মুখস্থ করা শুরু করেন। এ সময়ই তিনি প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ বিন মুবারক (রহ.) এবং ওয়াকি বিন জাররাহ (রহ.)-এর সব পাণ্ডুলিপি মুখস্থ করেন। তখন থেকে হাদিস চর্চার প্রতি তাঁর অন্য রকম আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তিনি নিজেই বলেন, '১০ বছর থেকে হাদিস চর্চায় আমি প্রচণ্ড আগ্রহ অনুভব করি।' তিনি ১৭ বছর বয়সে হাদিস শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১৮ বছরের আগে থেকেই তাঁর কাছে লোকদের ভিড় বাড়তে থাকে। তিনি যখন হাদিস শিক্ষাদানে ব্রত হন, তখন তাঁর মুখে দাড়িও গজায়নি।
যাঁদের শিক্ষায় ধন্য হন ইমাম বোখারি : হাদিসের জ্ঞান অর্জনে হাজার হাজার মুহাদ্দিসের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ইমাম বোখারি (রহ.)। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মুহাদ্দিসগণ হলেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.), ইয়াহইয়া বিন মায়িন, আলী ইবনুল মাদিনী এবং ইসহাক বিন রাহওয়াই।
উচ্চতর শিক্ষা লাভে বিদেশ গমন : ১৬ বছরেই তিনি মা এবং বড় ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম হজে যান। হজের পর তিনি মক্কা শরিফে থেকে যান এবং হেজাজের মুহাদ্দিসদের কাছে হাদিস পড়তে শুরু করেন। এ ছাড়া হাদিসের জ্ঞান লাভের অদম্য স্পৃহা নিয়ে তিনি চষে বেড়িয়েছেন সিরিয়া, বসরা, কুফা, মিসর, বাগদাদ, হেজাজসহ অসংখ্য ইসলামী নগরীতে। এসব শহর-নগরে তিনি বহুবার গিয়েছেন।
অসাধারণ স্মৃতিশক্তি : শৈশবেই তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি এবং তীক্ষ্ন মেধার স্ফূরণ ঘটে। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি হাদিসের সূত্রসহ কয়েক হাজার হাদিস মুখস্থ করেন। উল্লেখ্য, হাদিস মুখস্থ করা আর কোরআন মুখস্থ করার মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে। কারণ, হাদিসে শুধু বিষয়বস্তুই নয়, বরং বর্ণনা সূত্রেও সুবিশাল ধারাবাহিকতা রয়েছে। আর অজস্র অগণিত বর্ণনাকারীর নাম একটার সঙ্গে আরেকটার পার্থক্যসহ মুখস্থ করা বিশাল ও অসাধারণ কৃতিত্ব। এ ব্যাপারে মুহাম্মদ বিন হামদুওয়াহ (রহ.) বলেন, আমি ইমাম বোখারি (রহ.)কে বলতে শুনেছি, 'আমি এক লাখ বিশুদ্ধ হাদিস ও দুই লাখ অশুদ্ধ হাদিস মুখস্থ করেছি।' তাঁর স্মৃতিশক্তি কত প্রখর ছিল তা একটি ঘটনা থেকে অনুমেয়। ইমাম বোখারি (রহ.) তাঁর অন্য সহপাঠীর সঙ্গে বিভিন্ন মুহাদ্দিসের ক্লাসে অংশগ্রহণ করতেন। তখনকার যুগে নিয়ম ছিল শিক্ষক হাদিসের দরস দেবেন। আর ছাত্ররা তা নিজ নিজ খাতায় লিপিবদ্ধ করবে। ইমাম বোখারি (রহ.)-এর সহপাঠীরা শিক্ষকের কাছ থেকে হাদিস শুনে গুরুত্বসহকারে তা লিখলেও তিনি নীরবে বসে থাকতেন। কিছুই লিখতেন না। তারপর কোনো কোনো সহপাঠী তাঁকে বলল, অযথা মূল্যবান সময় নষ্ট করে কী লাভ? হাদিস যেহেতু লিখছই না, কাজেই তুমি চলে যাও। তাদের এহেন কথায় বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, আচ্ছা! তোমাদের লিখিত কপিগুলো নিয়ে এসো। তারা কপিগুলো নিয়ে আসলে তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শিক্ষকের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে তাদের সামনে হাদিসগুলো পাঠ করে শোনান। সহপাঠীরা তার পাঠ শুনে নিজ নিজ কপি সংশোধন করে নেন। সেই মজলিশে তাদের লেখা অনুযায়ী তিনি প্রায় ১৫ হাজার হাদিস মুখস্থ শোনান। তাঁর অসাধারণ মনীষায় প্রভাবিত হয়ে তাঁর সুযোগ্য ছাত্র ইমাম মুসলিম বিন হাজ্জাজ (রহ.) এক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছিলেন। হে ইমাম! হিংসুক ছাড়া কেউ এ ধরায় আপনার সঙ্গে শত্রুতা করতে পারে না। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, হাদিস শাস্ত্রে আপনার সমতুল্য এ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।
রচনাবলি : ইমাম বোখারি (রহ.) রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টিরও বেশি। বেশ কিছু গ্রন্থ হারিয়ে গেছে আর কিছু এখনো পাণ্ডুলিপি আকারে রয়ে গেছে। আর কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলি হলো- বোখারি শরিফ'। তাঁর আরো গ্রন্থ হলো- কাজায়াস সাহাব ওয়াত্তাবিয়ীন, আত-তারীখুস সগীর, আল আদাবুল মুফরাদ, কিতাবুল কুনা, আত-তারীখুল কবীর, আত-তারীখুল ওয়াসাত, আল জামিউল কবীর, আল মুসনাদুল কবীর, উসামাস সাহাবাহ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বোখারি শরিফ রচনা : ইমাম বোখারি (রহ.)-এর জীবনের শ্রেষ্ঠতম কাজ হচ্ছে- বোখারি শরিফের মতো একটি অনবদ্য হাদিস গ্রন্থের রচনা। গ্রন্থটি বোখারি শরিফ নামে প্রসিদ্ধি পেলেও এর প্রকৃত নাম "আল জামে'উল মুসনাদ আস-সহিহ আল মুখতাছারু মিন উমুরি রাসুলিল্লাহি (সা.) ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়ামিহি'।
মুহাদ্দিসীনদের অভিমত হচ্ছে, পবিত্র কোরআনের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশুদ্ধ গ্রন্থ বোখারি শরিফ। ২১৭ হিজরিতে ২৩ বছর বয়সে তিনি পবিত্র মক্কার হারাম শরিফে এ গ্রন্থের সংকলন শুরু করেন। ১৬ বছর নিরবচ্ছিন্ন সাধনা এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২৩৩ হিজরিতে এর সংকলন চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে। বোখারি শরিফ সংকলনের জন্য ইমাম বোখারি (রহ.)-এর একবার তাঁর প্রসিদ্ধ শিক্ষক ইসহাক বিন রাহওয়াহ (রহ.) ছাত্রদের উদ্দেশে বললেন, 'তোমাদের মধ্যে কি কেউ আছে, গায়রে সহিহ হাদিস থেকে সহিহ হাদিস পার্থক্য করে একটা গ্রন্থ সংকলন করতে পারে? এ ছাড়াও ইমাম বোখারি (রহ.) একবার স্বপ্নে দেখেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র দেহের ওপর মাছি এসে বসছে আর তিনি পাখা দিয়ে সেগুলোকে তাড়াচ্ছেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারী আলেমরা এর ব্যাখ্যা দিলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সহিহ হাদিসগুলো গায়রে সহিহ হাদিস থেকে পৃথক করার মতো মহান কাজ স্বপ্নদ্রষ্টা দ্বারা সম্পাদিত হবে। তখন থেকে ইমাম বোখারি (রহ.) মানসপটে একখানি সহিহ হাদিসের উচ্চাঙ্গ গ্রন্থ রচনার প্রতি প্রবল আগ্রহ এবং অদম্য স্পৃহা জাগ্রত হয়। পরবর্তী ১৬ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল হিসেবে বিশ্বমুসলিম পায় একখানা বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ বোখারি শরিফ।
বোখারি শরিফ এত গ্রহণযোগ্য কেন?
এ গ্রন্থটি এত বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিশ্বে সমাদৃত হওয়ার পেছনে বড় কারণ, এ গ্রন্থ সংকলনের ক্ষেত্রে ইমাম বোখারির (রহ.) অতিমাত্রায় সতর্কতা। বোখারি শরিফ সংকলনকালে তিনি ১৬ বছর রোজা রেখেছেন এবং প্রতিটি হাদিস গ্রন্থে সন্বিবেশিত করার আগে তিনি ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করার জন্য গোসল করতেন। এরপর দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে ইস্তিখারা, মোরাকাবা এবং ধ্যানের মাধ্যমে হাদিসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। মুহাদ্দিসীনদের অভিমত হলো, এই গ্রন্থে যত হাদিস আছে, সব হাদিসই সহিহ এবং বিশুদ্ধ। তবে হ্যাঁ, অনেকেই ধারণা করেন, বোখারি শরিফের বাইরে কোনো সহিহ হাদিস নেই। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ ইমাম বোখারি (রহ.) সব সহিহ হাদিস সংকলন করেননি। বরং সহিহ হাদিসগুলোর মধ্যে যেসব হাদিস তাঁর বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়েছে, কেবল সেগুলোই তিনি সন্নিবেশ করেছেন বোখারি শরিফে। তিনি নিজেই বলেন, আমি আমার জামে বোখারি শরিফে সহিহ হাদিস ছাড়া অন্য কোনো হাদিস উল্লেখ করিনি। তবে গ্রন্থের কলেবর অতিমাত্রায় বড় হয়ে যাবে, এই আশঙ্কায় আমি অনেক হাদিসই এখানে অনুল্লেখ করেছি। তিনি আরো বলেন, আমি আমার গ্রন্থে প্রতিটি হাদিস লিপিবদ্ধ করার আগে ভালোভাবে গোসল করেছি এবং দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেছি। বোখারি শরিফের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- তরজমাতুল বাব (শিরোনাম)। তিনি বোখারি শরিফের শিরোনামগুলো রাসুলে করিম (সা.)-এর রওজা মুবারক ও মসজিদে নববীর মধ্যস্থলে বসে লিখেছিলেন এবং প্রত্যেক শিরোনামের জন্য দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেছেন।
হাদিস সংখ্যা : বোখারি শরিফে সর্বমোট ৯ হাজার ৮২টি হাদিস সংকলিত হয়েছে। তাকরার বা পুনরাবৃত্তি (যা বিশেষ প্রয়োজনে করা হয়েছে) ছাড়া এই সংখ্যা মাত্র দুই হাজার ৫ শ তেরতে দাঁড়ায়। মুআল্লাক ও মুতাবাআত যোগ করলে এর সংখ্যা পৌঁছায় ৯ হাজার ৮২-তে। উপমহাদেশে প্রচলিত বোখারি শরিফের বর্ণনাকারী আল্লামা ফারাবি (রহ.)-এর বর্ণনা অনুসারে বিখ্যাত ভাষ্যকার আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী (রহ.) (৭৭৩-৮৫২ হি.) কর্তৃক গণনার সংখ্যা এখানে প্রদত্ত হয়েছে। তবে ইমাম নববী (রহ.)-এর মত হচ্ছে বোখারি শরিফে তাকরারসহ হাদিসের সংখ্যা ৭ হাজার ২৭৫। পুনরাবৃত্তি বাদ দিলে এর সংখ্যা হয় প্রায় চার হাজার, বোখারি শরিফে ২২টি ছুলাছি (যে হাদিসে ইমাম বোখারি (রহ.) এবং রাসুল (সা.)-এর মধ্যে মাত্র তিনজন বর্ণনাকারী রয়েছেন) হাদিসে আছে, যা সিহাহ সিত্তার (প্রসিদ্ধ ছয় বিশুদ্ধ গ্রন্থ) অন্য কোনো গ্রন্থে নেই। বোখারি শরিফে ৯৮টি অধ্যায় এবং তিন হাজার ৪৫০টি অনুচ্ছেদ রয়েছে।
চারিত্রিক গুণাবলি : ইমাম বোখারি (রহ.) খুব অল্প খেতেন। তিনি ছিলেন দরবেশ প্রকৃতির, খোদাভীরু ও যাহেদ। ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল। দানশীলতায় ছিলেন তিনি অদ্বিতীয়। তাঁর সততা, বিশ্বস্ততা এবং খোদাভীতি তখন জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছিল।
অন্তিম সায়াহ্নে ইমাম বোখারি (রহ.) : ইসলামী জগতের কিংবদন্তি পুরুষ ইমাম বোখারি (রহ.) সমরকন্দের খরতঙ্গে ৬২ বছর বয়সে ২৫৬ হিজরীর ১ শাওয়াল, ৩১ আগস্ট, ৮৭০ খ্রিস্টাব্দের শুক্রবার দিবাগত রাতে মৃত্যুবরণ করেন। সমরকন্দের নিকটবর্তী গ্রাম খরতঙ্গে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।
কবর থেকে সুগন্ধি বের হওয়া : জানাজার পর যখন তাঁকে কবরে রাখা হয়, তখন তাঁর কবরের মাটি থেকে মেশক আম্বরের সুগদ্ধ বাতাস প্রবাহিত হয়ে চারদিক মোহিত করে তোলে। অনেক দিন পর্যন্ত সেখানকার লোকেরা কবরের মাটি নিয়ে তা থেকে মেশক আম্বরের সুগন্ধ নিতেন এবং আশ্চর্যবোধ করতেন।

No comments:

Post a Comment